সাইবার সিকিউরিটির ধারনা
আগের দিনে আমাদের মূল্যবান সম্পত্তি বলতে টাকা-পয়সা, গহনা এগুলোকেই বুঝানো হত। মানুষ তাদের এইসব সম্পত্তি গোপনীয় কোন স্থানে সংরক্ষণ করে রাখতো৷ অথবা বড় কোন তালা বা লকারের মাধ্যমে লুকিয়ে রাখত। যাতে করে কেউ তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি চুরি করতে না পারে।
বর্তমানে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি বলতে তাদের নিজেদের তথ্য, ফাইল বা ডকুমেন্টস কে বুঝায়। এইসব ডকুমেন্টস মানুষ আগের দিনে কাগজে লিখে রাখত বা ফটোকপি করে না প্রিন্ট করে রাখত। কিন্তু এখন মানুষ তাদের তথ্য, ফাইল বা ডকুমেন্টস ইন্টারনেটে সংরক্ষণ করে রাখে৷
কিন্তু ইন্টারনেটেও মানুষের তথ্য বা ডকুমেন্টস চুরি হাওয়ায় সম্ভাবনা আছে৷ হ্যাকার বা চুরেরা যাতে আমাদের তথ্য চুরি করতে না পারে এই জন্য আমরা অনেক ধরনের লক বা সিকিউরিটি ব্যবহার করে থাকি। আমাদের তথ্য, ফাইল বা ডকুমেন্টস রক্ষা করার জন্য। ইন্টারনেটের ভাষায় যাকে আমরা বলি সাইবার সিকিউরিটি।
সাইবার সিকিউরিটি কী?
যে কোন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত তথ্য আমরা ইন্টারনেটে রাখতেই পারে। কিন্তু সেই সব তথ্য যারা ইন্টারনেট ভিত্তিক চুর আছে তারা চুরি করতে পারে৷ যাদের কে আমরা হ্যাকার বলি। সেই হ্যাকাররা এইসব গুরুত্বপূর্ণ, গোপনীয় ডাটা গুলোকে চুরি করে ছড়িয়ে দিতে পারে সবার কাছে৷ অথবা সেইসব তথ্য নষ্ট করে দিতে পারে। ইন্টারনেট ভিত্তিক তথ্য, ফাইল বা ডকুমেন্টসকে খারাপ মানুষের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বা যাতে কেউ চুরি না করতে পারে, এই জন্য আমরা যে লক সিস্টেম ব্যবহার করি বা পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে আমাদের ফাইল গুলোকে রক্ষা করি। তাকেই মূলত সাইবার সিকিউরিটি বলে। অথবা আমারা বলতে পারি, যে কোন তথ্য বা নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা প্রদান করা কেই সাইবার সিকিউরিটি বলে।
সাইবার সিকিউরিটি কেন দরকার?
বর্তমানে আমরা সবাই কোন না কোন ভাবে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত। বন্ধুদের সাথে কথা বলা, ছবি শেয়ার করা, ঘুরতে যাওয়া সব মুহুর্ত গুলো আমারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে থাকি। আমাদের প্রতিটি ভাল লাগা খারাপ লাগা ইন্টারনেটে শেয়ার করে থাকি৷ এছাড়াও আমরা বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য ইন্টারনেটে শেয়ার করে থাকি যেমন নিজেদের ফোন নাম্বার, ইমেইল ঠিকানা, নিজেদের ঠিকানা, আইডি কার্ডের নাম্বার ইত্যাদি। যার ফলে আমাদের প্রতিটি তথ্য ইন্টারনেটে চলে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত তথ্য থেকে শুরু করে যে কোন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, হাসপাতাল, শিল্প-কারখানার তথ্যও তারা ইন্টারনেটে সংরক্ষণ করে রাখে। ইন্টারনেটে থাকা আমাদের প্রতিটি তথ্য চুরি হাওয়ায় সম্ভাবনা থাকে। ইন্টারনেট ভিত্তিক যে কোন তথ্য চুরি বা তথ্য নষ্ট করে দেওয়াকে আমারা হ্যাকিং বলে থাকি।
কেন সাইবার সিকিউরিটি এতো গুরুত্বপূর্ণঃ
- আমাদের ব্যক্তিগত কম্পিউটারে থাকা সব file, Documents, photo কে রক্ষা করা
- সরকারি প্রতিষ্ঠানের documents, file কে চুরি বা নষ্ট করার হাত থেকে রক্ষা করা।
- ব্যংক বা বীমা প্রতিষ্ঠান থেকে যাতে কেও টাকা চুরি করতে না পারে বা তাদের তথ্য চুরি করতে না পারে সেই জন্য সাইবার সিকিউরিটি দরকার।
- বর্তমান সময়ে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান তাদের তথ্য ইন্টারনেট ভিত্তিক সার্ভারে সংরক্ষণ করে রাখে৷ সেই সার্ভারকে নিরাপদ রাখার জন্যও সাইবার সিকিউরিটি দরকার।

হ্যাকিং কি, কেন, কীভাবে হয়
সাইবার সিকিউরিটি সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের হ্যাকিং সম্পর্কে ধারনা থাকাটা জরুরী। ইন্টারনেট ভিত্তিক যে কোন তথ্য বা ডকুমেন্টস মালিকের অনুমতি ব্যাতিত ব্যবহার করা বা নষ্ট করে দেওয়া কেই হ্যাকিং বলা হয়।
হ্যাকিং কেন হয় এটা আমারা সুন্দর একটা উদাহরণের মাধ্যমে বুঝতে পারি। ধরুন আপনি একটা বাড়ি তৈরি করলেন। সে বাড়িতে আপনি কোন তালা না লক সিস্টেম ব্যবহার করলেন না, বা এমন তালা বা লক সিস্টেম ব্যবহার করলেন যা সবাই খুলতে পারবে। সেই বাড়িতে আপনি আপনার গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি রেখে দিলেন। ধরুন আপনার বাড়ির আসেপাশে অনেক খারাপ মানুষ আছে যারা আপনার বাড়িতে ঢুকে আপনার সব সম্পত্তি চুরি করে নিল। তাহলে আমরা বলতে পারি যে আপনার সেই বাড়িতে সিকিউরিটি সিস্টেম দূর্বল ছিল, যার কারনে চুর খুব সহজে বাড়িতে ঢুকে সব কিছু চুরি করে নিয়েছে।
এই পূরো উদাহরণ টা কে আমরা ইন্টারনেটের সাথে তুলনা করতে পারি। ইন্টারনেটের প্রতিটা একাউন্টকে আমরা একেকটা বাড়ির সাথে তুলনা করতে পারি। যদি আমাদের একাউন্টের লক বা সিকিউরিটি সিস্টেম দূর্বল থাকে তাহলে যে কেও আমাদের একাউন্ট থেকে তথ্য চুরি করতে পারবে।
আমাদের একাউন্ট থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যাতে কেও তথ্য চুরি করতে না পারে, এই জন্য আমরা আমাদের একাউন্টে শক্তিশালী লক বা পাসওয়ার্ড সিস্টেম ব্যবহার করে থাকি। সাইবার সিকিউরিটি মূলত আমাদের বলে দেয় কীভাবে আমাদের তথ্যকে ইন্টারনেটের চুরির হাত থেকে রক্ষা করতে পারি৷ সাইবার সিকিউরিটি যে শুধু মাত্র আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়, তা কিন্তু নয়। ব্যক্তিগত তথ্য থেকে শুরু করে, যে কোন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, হাসপাতাল, শিল্প-কারখানা সব জায়গায় তথ্য চুরির সম্ভাবনা থাকে। সেই জন্য এইসব প্রতিষ্ঠানেও সাইবার সিকিউরিটি দরকার৷
সাইবার সিকিউরিটি প্রকারভেদঃ
১. তথ্য নিরাপত্তাঃ ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য যাতে করে কেও অনুমতি ব্যাতিত ব্যবহার বা নষ্ট করতে না পারে তার জন্য যে সিকিউরিটি সিস্টেম ব্যবহার করা হয় তাকেই মূলত তথ্য নিরাপত্তা বলে।
২. অ্যাপলিকেশন সিকিউরিটিঃ অ্যাপলিকেশনের ত্রুটির কারণে আমাদের তথ্য বা ইনফরমেশন চুরির প্রবল সম্ভাবনা থাকে৷ অ্যাপলিকেশন ডিজাইন, ডেভেলপমেন্ট, ইইনস্টলেশন, আপগ্রেড পর্যায়ে ত্রুটির কারণে সৃষ্টি দূর্বলতা থেকে অ্যাপলিকেশনকে রক্ষা করা৷
৩. নেটওয়ার্ক সিকিউরিটিঃ আমাদের বেশির ভাগ হ্যাকিং না চুরি নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। সাধারণত ডাটা ট্রান্সফারের সময় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্যের যে চুরি হয়, সেইটার হাত থেকে নেটওয়ার্ককে সুরক্ষিত রাখাকে নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি বলে।
৪. ক্লাউড সিকিউরিটিঃ ক্লাউড সাধারণত কোন file, documents, data স্টোর করার জন্য ব্যবহার করা হয়। সেই স্টোরকৃত file, documents, data যদি কোন দুর্বল ক্লাউডে স্টোর করা হয় তখন তা চুরি হবার সম্ভাবনা থাকে। ক্লাউড থেকে যাতে কোন কিছু চুরি না হয়, সেই জন্য যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাকেই ক্লাউড সিকিউরিটি বলে৷

সাইবার সিকিউরিটির ক্যারিয়ার
দেশ ও দেশের বাইরে সাইবার সিকিউরিটির প্রচুর পরিমানে চাকুরী রয়েছে, যেখানে প্রচুর পরিমানে দক্ষ সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিষ্ট দরকার। আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, হাসপাতাল, শিল্প-কারখানা সব জায়গাতে সাইবার সিকিউরিটি দরকার। সাধারণত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিষ্টদের বেতন হয়ে থাকে। তবে একজন মিড লেভেল সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিষ্ট এর বেতন ৪০,০০০ হাজার থেকে ৬০,০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে৷ আরো বিস্তারিত বলতে গেলে একজন সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিষ্ট বছরে ১০ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ইনকাম করতে পারে। দেশ ও দেশের বাইরে সাইবার সিকিউরিটির অনেক চাকুরী রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সিংগাপুরের একটা রিপোর্ট অনুযায়ী, তাদের এই মূহুর্তে ১০-১৫ হাজার সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিষ্ট দরকার। কিন্তু তাদের কাছে মাত্র ২-৩ হাজার সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিষ্ট আছে৷ সুতরাং খুব সহজেই বুঝা যাচ্ছে, দেশ ও দেশের বাইরে অনেক সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিষ্ট দরকার। এমন কি অনেক জব ফিল্ডও রয়েছে এই সেক্টরে।
সুতরাং আমরা বলতে পারি বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাইবার সিকিউরিটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা টপিক। যেখানে ১-১.৫ বছর সময় দিলেই সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিষ্ট হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব।
KH Mehedi Hasan
Instructor