কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন-22

কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন

মহাবিশ্বের সৃষ্টি বা সূচনা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই! কোথা হতে এলো এই মহাবিশ্ব? উত্তর যদি হয় বিগ ব্যাং, এরপরেও প্রশ্ন থেকেই যায় বিগ ব্যাং এর পূর্বে কি ছিল? শূন্য থেকেই কি মহাবিশ্বের সৃষ্টি? সময়টাই যে বিন্দু থেকে শুরু হয়েছে সেই বিন্দুর আগে বা সময় তৈরির সূচনার বিন্দুর আগে কি-ই বা থাকতে পারে? এই পরম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা অতি ক্ষুদ্র কণিকার জগতে প্রবেশ করলেন এবং অবাধ্য ক্ষুদ্র কণিকাগুলোর অপরিচিত আচরণ বোধগম্য ও ব্যাখ্যা করার জন্য “কোয়ান্টাম ফিজিক্স” নামে পদার্থবিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা প্রতিষ্ঠিত করা হলো। কোয়ান্টাম ফিজিক্স মহাবিশ্বের উৎপত্তির ধারণা দিতে গিয়ে “কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন” নামক এক চমকপ্রদ বিষয় আবিষ্কার করলো।

কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন নিয়ে আলোচনার পূর্বে “শূন্যতা” নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। সাধারণত কোন কিছুর উপস্থিতি না থাকাকেই আমরা শূন্যতা বলি। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় সেখানে কোন বাহ্যিক কণিকা থাকতে পারবেনা, তবে সর্বদা শক্তির উপস্থিতি থাকবে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে যাকে কোয়ান্টাম শূন্যতা বলে। এই শূন্যতার প্রতিটি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্তরে সবসময়ই ঘটে চলেছে নানান প্রক্রিয়া। কিন্তু কী সেই নানান কর্মকান্ড যা কিনা শূন্যতাকে প্রতিনিয়ত এতটা অশান্ত করে রেখেছে? আসলে শুন্যস্থানের সূক্ষ্মস্তরে প্রতিনিয়ত শক্তি ও ভরের অদল-বদল ঘটছে। এবং এর ফলে সেখানে প্রতি মুহূর্তে শক্তি রুপান্তরিত হচ্ছে ভরে তথা কণায়।

প্রকৃতিতে এমন এক কণার অস্তিত্ব আছে যা আমাদের পরিচিত কণা ইলেকট্রনের সম্পূর্ণ বিপরীত। আর একটি কনাকে আমরা অন্য একটি কণার বিপরীত তখনই বলি যখন তাদের মধ্যকার ভর সমান কিন্তু চার্জ পরস্পরের বিপরীত। অর্থাৎ ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এর বিপরীত কণিকাটি হবে ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট, যাকে পজিট্রন বলে। এই প্রতিকণার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে,একে যদি কোনো কণার সংস্পর্শে নিয়ে আসা হয় তাহলে এটি সেই কণার সাথে মিলিত হয়ে উভয়কে ধ্বংস করে দেয় এবং বিনিময়ে তাদের ভরের সমতুল্য পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে (আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভর শক্তি সমীকরণ E‌=mc2 অনুসারে)।

পদার্থবিজ্ঞানে শূন্যস্থান হতে কণা সৃষ্টির এই বিষয়টিকে বলা হয় “কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন” বা “ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন”। কিন্তু এই কণা স্থায়ী হতে পারে না,সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে গিয়ে আবার শক্তিতে পরিণত হয় ও শুন্যতার সাথে মিশে যায়। কারণ শূন্যস্থান থেকে যখন কণা সৃষ্টি হয় তখন সে কখনোই একলা একলা উৎপন্ন হতে পারে না। তার সাথে প্রতিকণাও যুগপৎ ভাবে উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ শূন্যতার মধ্যেই কিন্তু এক ধরণের শক্তি লুকিয়ে আছে; আর সেটাই তৈরি করে ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে পদার্থ তৈরির প্রাথমিক ক্ষেত্র। হাইজেনবার্গের বিখ্যাত অনিশ্চয়তা তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ‘রহস্যময়’ এই শূন্য শক্তি কিংবা ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটি গড়ে উঠেছে। হাইজেনবার্গ গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে দেখান যে, কোন বস্তুর অবস্থান এবং ভরবেগ যুগপৎ একসাথে নিশ্চিত ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করতে গেলে ভরবেগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না, আবার ভরবেগ পরিমাপ করতে গেলে বস্তুর অবস্থান অজানাই থেকে যাবে। কাজেই হাইজেনবার্গের এই সূত্রানুসারে, ‘পরম শূন্যে’ও একটি কণার ‘ফ্লাকচুয়েশন’ বজায় থাকার কথা, কারণ কণাটি নিশ্চল হয়ে যাওয়ার অর্থই হবে এর অবস্থান এবং ভরবেগ সম্বন্ধে আমাদেরকে নিশ্চিত তথ্য জানিয়ে দেওয়া,যা প্রকারান্তরে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের লঙ্ঘন। বিজ্ঞানীরা কিন্তু ব্যবহারিক ভাবেই এর প্রমাণ পেয়েছেন। একটি প্রমাণ হচ্ছে ‘ল্যাম্ব শিফট’, যা আহিত পরমাণুর মধ্যস্থিত দুটো স্তরে শক্তির তারতম্য প্রকাশ করে। আরেকটি প্রমাণ হল টপ কোয়ার্কের ভরের পরিমাপ।তবে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের সবচেয়ে জোরদার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিখ্যাত ‘কাসিমিরের প্রভাব’ থেকে।

শূন্যস্থানে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন ঘটার ফলে শূন্য হতেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কণা-প্রতিকণা সৃষ্টি হয়। গবেষকদের ধারণা, সৃষ্টির আদিতে মহাজাগতিক শূন্যতায় কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ফলে যেসকল কণার সৃষ্টি হয়েছিল,সেগুলিই গঠন করেছে আমাদের আজকের এই মহাবিশ্ব। এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, কণা এবং প্রতিকণা পরস্পরকে ধ্বংস করে দিলে আর কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলছে, কিছু কণা কোন ভাবে প্রতিকণার সাথে সংস্পর্শ এড়িয়ে যায় এবং এদের থেকেই পরবর্তীতে বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের সূচনা হয়। প্রতিনিয়ত মহাশূন্যে এভাবেই হয়তো আরও হাজারো নতুন নতুন মহাবিশ্বের সৃষ্টি হচ্ছে!

রাফসান বিন আতা
ইন্সট্রাক্টর
ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট

Tags: No tags

Comments are closed.