এক এর শুরু ছয় এ (One's Start at Six)-01-01

এক এর শুরু ছয় এ

খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করে লাফাতে লাফাতে সজীব তার ঘুমন্ত বড় ভাইকে জাগিয়ে তোলে। আচমকা ঘুম ভাঙ্গায় বেশ বিরক্ত হয়ে পিঠে একটা কিল উপহার পেলো সজীব। তারপরেও ভালোবাস পূর্ন সম্মানে ছোট ছোট দাত গুলো বের করে হাসি দিয়ে বললো ওই ওঠরে আমাকে স্কুলে নিয়ে চল। চোখ কচলাতে কচলাতে বড় ভাই বললো হুম যাবিতো কিন্তু এতো লাফানোর কিছু নাই। গেলে বুঝবি পড়ার কি চাপ তখন এমনি পালাবি। বড় ভাই ঘুম থেকে উঠে মা কে ডেকে সজীব কে রেডি করতে পাঠিয়ে দিলো। ওহ, হ্যা কথার শুরুতে বলে রাখি, আজ সজীবের প্রথম দিন স্কুলে। ক্লাস ওয়ানে সে আজ প্রথম ক্লাস করতে যাবে। চিরো চেনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই সাদা শার্ট আর নীল রঙ্গের প্যান্ট ইন করে মাথায় হাল্কা সরিষার তেল দিয়ে সুন্দর করে সেজে রেডি সে। ছোট ছোট ইদুরের মত দাতের কোনায় দুটা বাঁকা দাঁতের হাসিটা যেন বাধ ভেঙ্গে বের হয়ে আসছে। এদিকে সজীবের বড় ভাই আর দশ টা দিনের মত রেডি। তবে আজ সাথে মা আর ছোট আদুরে ভাইটাও যাবে। ছোট বিড়াল ওয়ালা বেগুনি নীল  ব্যাগ আর তাতে খাতা পেন্সিল আর বই আছে সজীবের। বড় ভাইয়ের একটি হাত আর মা এর একটি হাত ধরে দোল খেতে খেতে হেটে চলেছে সে। চিকোন পাতলা হাড্ডিসার সজীব এই পথ হেটে আসতে আসতেই দু বার হোঁচট খেয়ে মাখামাখি অবস্থা। স্কুলের অফিস রুমে বসে থাকা প্রধান শিক্ষিকা সজীবকে দেখে কেমন আছো আর দু চারটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে আয়া আন্টির সাথে পাঠিয়ে দিলো ক্লাস ওয়ানের কক্ষে। এদিকে বড় ভাই তার নিজ পঞ্চম শ্রেনীর ক্লাসে চলে এসেছে। একই স্কুলে দু ভাই পড়ার মূহুর্তটাই অন্য রকমের। স্কুলের প্রথম দিনের বাংলা ক্লাস টি বেশ মজায় মজায় কাটলো সজীবের। ছড়া কবিতা আর ক্লাসের নতুন বন্ধুর সাথে। প্রথম ক্লাসেই সে জুটিয়ে নিয়েছে একটা বন্ধু যদিও সেটা নাকি তার মা ঠিক করে দিয়েছিলো। প্রথম দিনের এতো সব মজার মধ্যেও প্রথম বিপত্তিটা ঘটলো ইংলিশ ক্লাসে। ম্যাডাম এসে সবাইকে বললো ছোট হাতের a b c d লিখতে। ব্যাস, সে বড় হাতের লিখে জমা দিলো। যদিওবা তার আর কি দোষ, এই টুকু বয়সে ভাষায় আবার বড় হাত ছোট হাত কিসের তা না বুঝাও স্বাভাবিক। অবশ্য সে শুধু বড় হাতের টা শিখেই ভর্তি হয়েছিলো। তাই ছোট হাতের লিখার সাথে পরিচিত তো নয়ই বরং তার কাছে এটা আজবও ছিলো। তো লিখা জমা দেয়ার পর যা হওয়ার তাই হলো, কপালে শনির নজর মানে ম্যাডামের কাছে বেতের পিটুনি। বেচারা সরল মনা, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলোনা তার ভুলটা কোথাই। হাতটা ঝারা দিতে দিতে বেঞ্চে এসে বসার কিছুক্ষন পর ঘটলো দ্বিতীয় বিপত্তি। প্রচণ্ড প্রসাব পেয়ে বসে তাকে। লাজুক গলাইয় ম্যাডামকে বলে অনুমতিতো নিলো কিন্তু বাচ্চা মানুষ ভুলে গিয়েছে কোথায় টয়লেট। প্রসাবের চাপের কারনে আর কিছু না ভেবেই দু তলা থেকে নেমে দিলো দৌড় স্কুল এর একমাত্র মাঠটিতে। কি ভেবে যেন সে আর আগে পিছে না তাকিয়েই পতাকা স্ট্যান্ডের পাশে থাকা বড় ঘাস গুলোতে কাজ টি সেরে ফেললো। ওদিকে অন্যান্য ক্লাসের সবাই তাকিয়ে অবাক এই ম্যাজিক্যাল মূহুর্তের দৃশ্যে। ক্লাসে ফিরে দেখে সবাই ওর দিকে হা করে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। ইংলিশ ম্যাডাম একটু সদয় ভঙ্গিতে তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো কি সমস্যা। বেচারা আরো লাজুক কণ্ঠে বললো সে টয়লেট চিনে না। আজ তার প্রথম দিন স্কুলে। ম্যাডাম একজন ক্লাসমেটকে সাথে দিয়ে তাকে টয়লেট টা চিনিয়ে দিলো। ইংলিশ ক্লাস শেষে গণিত ক্লাসে ঘটলো আরেক মজার কান্ড। যোগের অংকে ৯+৯=১৮ না লিখে লিখলো ১৯। তার মতে দুটা ৯ এর মধ্যে একটাও ৯ থাকবেনা এটা কেমন কথা যেখানে ১০ আর ১০ যোগে ২০ হয় সেখানে একটা শূন্য আছে অন্তত। দিনের শেষ পিটুনিটাও সেদিন জুটলো তার। স্কুল শেষে ফেরার সময় প্রধান শিক্ষক সজীব আর তার বড় ভাইকে ডেকে মাঠে প্রসাব করার বিষয় টা জানিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে দিলো যেহেতু প্রথম দিন তার। বাসায় ফিরে সারাদিনের এসব কাজ নিয়ে অনেক হাসা হাসি হলো নিজেদের মধ্যে, বড় ভাই তো কিছুটা রাগ করেছিলো মাঠের বিষয় নিয়ে। একটু লজ্জা শরমের বিষয় বলে কথা। দিন যায় সপ্তাহ যায় এইভাবে সজীব প্রতিদিন কিছুনা কিছু একটা ঘটাতই। পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলোনা। ফাঁকিবাজিটা খুব জানতো। অবশ্য ছোট বেলায় সবাই একটু আরটু এমন হয় কিন্তু সজীবের বিষয় টা অন্য রকম। প্রায়োশই এমন টিচারের হাতে পিটুনি খেতে খেতে অনেকটা স্কুল থেকেই দূরে সরে যেতে থাকলো। আসলে সে স্কুলের পড়া আর বাসায় পড়ার বিষয় টা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলোনা। একে তো তার বড় ভাই নিজের পড়া আর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যাস্ত ছিলো ওদিকে তার মা ছিলো অফিসের কাজে ব্যাস্ত, সারাদিন কাজ ,কিছুটা উপরি ইনকামের জন্য ওভার টাইম সব মিলিয়ে এক্সট্রা পড়ায় তাকে হেল্প করার সুযোগ খুব কম ছিলো। অবশ্য সে ফাঁকিবাজ থাকায় এই সুযোগ টা কাজেও লাগায়। গল্পে এই অংশে অনেকেই বলতে পারেন তাহলে সজীবের বাবা কোথায়? আসলে তার বাবা অনেক ছোট বেলায় মারা যায়। এক মা একার হাতে সংসার আর কর্ম জীবন সামলায়। হ্যা সজীবের ভাই সব সময় তার একজন ভালো বন্ধু ভালো অভিভাবক হিসেবেই ছিলো। যদিও সে নিজেও তো ছোট। আসলে দায়িত্বটা বয়সে আসেনা, সময়ের প্রয়জনে হয়। যাইহোক অনেকটা অগোচরেই কেটে যাচ্ছিলো সজীবের স্কুল লাইফ। কখনো ঘুড়ি ওড়ানো, কখনো বর্শি সুতায়  মাছ ধরা, কখনো সারা দিন ক্রিকেট, মার্বের, লাটিম খেলা। একবার তো শোনা যায় ক্লাসের ম্যাডামের হাতের পিটুনির ভয়ে ক্লাস থ্রিতে ২ মাস স্কুলে যায়নি, শখের দুধ ওয়ালা হয়ে দুধ দিতো মানুষের বাসায়। কখনো কখনো মহল্লার নির্মানাধীন বাড়ির রাজমিস্ত্রীদের সাথে সারা দিন কাটাত। স্কুলে যাওয়ার নাম শুনলেই শুরু হতো নানান বাহানা, পেট ব্যথা বুক ব্যাথা জ্বর মাথা ঘোরা আর কত কি। স্কুল তাকে টানেনি সে সময় দুটা কারনে, স্কুলের শেখানোর চাইতে শিক্ষার্থীদের থেকে রেডিমেড পড়া প্রাপ্তিতে আগ্রহো বেশি যার ফলে প্রাইভেট টিউশন এর বেশি উদ্ভোব, শিক্ষার্থীর ধরনের উপর শিক্ষা না দেয়ায় শেখার গতি কম ও আরো দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়া আরেক কারন। অবশ্যই এখানে তার ক্লাসে নিয়মিত না আসাটা বড় একটা কারন তবে পড়া না পাড়ায় পিটুনির ভয়টাও তাকে পেয়ে বসেছিলো এটাও বলতে হয়। যাইহোক এভাবেই তার বিশেষ বিবেচনায় পাস এ চলছিলো স্টুডেন্ট লাইফ। দেখতে দেখতে ক্লাস ফাইভে এসে সমাপানি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। পাস তো করলো কিন্তু ডি গ্রেডে। ডি গ্রেডের মানে কি আর এতে কি হয় না বোঝা ছেলেটির দিকে এইবার একটু বেশিই নজর পরলো তার বড় ভাইয়ের। রাতের খোলা আকাশের নিচে দু ভাই বসে অনেক গল্প করতে থাকলো নিজেদের করনীয় নিয়ে। একে একে সজীব তার অংকের দুর্বলতা ভয় এর কথা জানালো। ক্লাসে টিচারের পিটুনির আতংক আর স্কুল মুখির অনিহার কথাও জানালো। পড়াশোনার গুরুত্ব, সম্মান, জীবন এসব নিয়ে বাস্তবতার জ্ঞান দিলো তার বড় ভাই। গল্পে গল্পে জানালো আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং এর কথা। ফ্লেমিং কিভাবে কোন দিন স্কুল ফাঁকি দেয়নি একটা দিনের জন্যেও। ঝর বৃষ্টি যাইহোক তবু সে স্কুলে উপস্থিত থাকতো। ব্যাস এই ওষুধটা কাজ করলো সজীবের উপর। সে বললো, হয়তো কখনো আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং এর রেকোর্ড ভাংতে পারবোনা, তবে এই টা আমার লক্ষ্য পন আজ থেকে কোন দিন একটা ক্লাসও মিস করবনা। পরিবর্তন তখন থেকেই। একজন মানুষ কখন কিভাবে পাল্টে যায় বা বিবেক উদিত হয় বুঝা কঠিন। দুটা কথা কিংবা একটা মুহুর্তই পাল্টে দিতে পারে অনেক কিছু। ক্লাস সিক্সের প্রথম দিন হতে ক্লাস টেনের শেষ ক্লাস পর্যন্ত যতই ঝর বৃষ্টি হরতাল , জ্বর অসুখ থাকুক কোন একটা সিংগেল দিন তার অনুপস্থিতি নাই ক্লাসে। একেবারে ১০০% তে ১০০% উপস্থিতি। মজা করে অনেক টিচার তো বলতো ভুল করে ক্লাসে না আসতে। এই জন্য প্রতি বছর সর্বোচ্চ উপস্থিতির পুরোস্কার তো পেতই আর রেকোর্ড টাও এখন পর্যন্ত তারই। সব চেয়ে মজার বিষয় তার এই নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতিটাই তাকে সব চেয়ে পিছনের গ্রেডের স্টুডেন্ট থেকে টপ স্টুডেন্ট এ রুপান্তর করেছে।

মূলত, আজকের এই গল্পটা সেই সকল ভাই বোনদের জন্য যারা ক্লাসে উপস্থিত কম থাকায় দুর্বল শিক্ষার্থীতে রুপান্তরিত হয়েছে। একটা শিক্ষার্থী পড়া করুক আর নাই করুক, বুঝুক আর নাই বুঝুক তবু  ক্লাসে শতভাগ  উপস্থিত থাকা আবশ্যক। এতে বিবেকের তারনায় হলেও সে পড়া শোনা করে আসে বা সেই টপিকস নিজে থেকে বুঝে আসে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে।

আর হ্যা, এটা কোন গল্প না। এটা বাস্তব ঘটনা। সজীব আমার আপন এক মাত্র ভালোবাসার স্নেহের ছোট ভাই। এই ঘটনা লিখা পর্যন্ত তার বর্তমান সর্বশেষ হলো সে এখন পর্যন্ত কোন ক্লাস অনুপস্থিত নেই ক্লাস সিক্স হতে। আলহামদুলিল্লাহ সে এরই প্রেক্ষিতে ফুল ফ্রি স্কলারশিপে দেশের বাহিরে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং(ইলেক্ট্রিক্যাল) লাস্ট ইয়ার এর একজন টপ শিক্ষার্থী। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই ঘটনা উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুক।

সকল শিক্ষার্থীর প্রতি রইলো শুভ কামনা।

কপি রাইটঃ এস. এম. রাজিব আহম্মেদ

ইন্সট্রাকটর, কম্পিউটার সাইন্স টেকনোলজি

ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট

Tags: No tags

Comments are closed.